eaibanglai
Homeএই বাংলায়সুন্দরী 'লবনধার' - এক অন্য গ্রামের গল্প

সুন্দরী ‘লবনধার’ – এক অন্য গ্রামের গল্প

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,আউসগ্রামঃ- আউসগ্রামের বিখ্যাত সুন্দরী জঙ্গলমহল। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গ্যাছে রাস্তা- কোথাও ঢালাই রাস্তা কোথাও বা লাল মোড়াম। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। গাছে নানা রকম পাখির কিচিরমিচির শব্দ। শুনলেই মন ভরে যায়। মাঝে মাঝে নাকি ময়ূরেরও দ্যাখা মেলে। সব মিলিয়ে অরণ্যের নীরব পরিবেশে এক অপার আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে এই এলাকা। এর কোনো শেষ নাই। সৌন্দর্যের টানে শুধু জঙ্গল প্রেমীরা নয় সাধারণ মানুষও ছুটে আসে। শীতের সময় তো তাদের আগমন বেড়ে যায়- কেউ আসে পিকনিক করতে, কেউবা সৌন্দর্যের টানে। মুহূর্তের মধ্যে ক্যমেরাবন্দী করে ফেলে সৌন্দর্যকে।

জঙ্গলের মাঝে মাঝে গড়ে উঠেছে আদিবাসী অধ্যুষিত জনবসতি। সেখানেও বিরাজ করে আর এক ভিন্ন স্বাদের সৌন্দর্য। এরকমই এক জনবসতি হলো দেবশালা অঞ্চলের ‘বড়ডোবা’ মৌজার লবনধার গ্রাম। এটি গড়ে ওঠার পেছনে লুকিয়ে আছে চমকপ্রদ কাহিনী।

কমপক্ষে তিনশ বছর আগের ঘটনা। পূর্ব বর্ধমানের আউসগ্রামের ঘন জঙ্গলের গা ছম ছম করা পরিবেশে দেবশালা অঞ্চলের বিখ্যাত ‘বড়ডোবা’-র তীরে ছিল এক বিশাল বটগাছ। শোনা যায় কোনো একসময় একটি পায়রা অথবা চিল সেই গাছের উপর এসে বসে। তখন ঐ ডোবাকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক আদিবাসী পাড়া। তবে শুধু আদিবাসী নয় জেনারেল কাস্টের মানুষও আছে অনেক।

অন্যদিকে আছে আর এক কাহিনী। এই রাজ্যের সবচেয়ে কলঙ্কময় ইতিহাস লুকিয়ে আছে ১৯৭২ সাল জুড়ে। সরকার বনাম নকশালদের সংঘর্ষ ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তরঞ্জিত হয়ে ওঠে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত। শোনা যায় পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘন জঙ্গলে আশ্রয় নিত নকশালরা। নকশাল দমনে তৎপর রাজ্য পুলিশের হাত থেকে রেহাই পায়নি আউসগ্রামের বেনাচাপড়া। সেখানেও রক্ত ঝড়তে শুরু করে। আতঙ্কিত হয়ে এলাকার বাসিন্দারা চলে আসে বড়ডোবায়। গড়ে তোলে এক ‘নতুনগ্রাম’। কিন্তু নতুনগ্রাম হিসাবে সেভাবে পরিচিতি পায়নি। উচ্চারণের ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণেই হোক নাম পরিবর্তিত হয়ে উঠেছে লবনধার। সেই নাম আজও চলে আসছে। ‘নামে কি এসে যায়’ নামের পরিবর্তন হলেও সৌন্দর্যের কোনো পরিবর্তন নাই।

তবে লোকের মুখে মুখে এই গ্রাম আবার ‘আল্পনা’ গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে এই নাম কে বা কারা দিয়েছে সেটা অজানা থেকে গ্যাছে গ্রামবাসীদের কাছে। তার পিছনেও লুকিয়ে আছে আর এক চমকপ্রদ কাহিনী।

ইতিহাস সাক্ষী আছে – সৌন্দর্যের প্রতি যুগ যুগ ধরে আদিবাসী রমণীদের একটা আলাদা প্রীতি আছে। শত দুঃখ-কষ্ট বা অভাবের মধ্যেও কোনোদিনও সেটা তারা ভোলেনি। ব্যক্তিগত ভাবে তারা যেমন সাজতে ভালবাসে তেমনি গৃহস্থালির মধ্যেও সেই সৌন্দর্য ধরা পড়ে। চর্যাপদের যুগ থেকে শুরু করে এই আধুনিক যুগেও তারা সেই ধারা বজায় রেখেছে। লবনধার গ্রামের প্রায় প্রতিটি আদিবাসী বাড়িতে তার অর্থবহ চিহ্ন পাওয়া যায়। মনসা মন্দিরে যেমন আছে সাপের চিত্র, তেমনি কোথাও আছে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। পশুপাখি, মাছ ইত্যাদি তো আছেই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে গ্রামের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্হানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্হা ‘লবনধার অন্নপূর্ণা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’-র উদ্যোগে এবং গ্রামবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতায় এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অরণ্যে অন্নপূর্ণা’ প্রোগ্রামের হাত ধরে বোলপুর, কলকাতা, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পেশাদার শিল্পীরা এসে এইসব চিত্র অঙ্কন করে গ্যাছেন। তবে যারাই অঙ্কন করুন না কেন প্রতিটি অঙ্কনের মধ্যে আদিবাসীদের স্বাভাবিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের পৌরাণিক চিত্রও ধরা পড়েছে। দেখলে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। এই সব চিত্র অরণ্যের সৌন্দর্যকে নুন্যতম ক্ষুণ্ন না করেও অরণ্য সুন্দরী লবনধার গ্রামের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিকমত প্রচারের আলোয় এলে আগামী দিনে পেছিয়ে পড়া এই গ্রামটির নাম পর্যটন মানচিত্রে উঠে যাবে। হয়তো পেছিয়ে পড়া এই এলাকার চিত্র সেদিন বদলে যাবে। যত বদলই ঘটুক গ্রামবাসীরা অরণ্যের জঙ্গলের পরিবর্তে কংক্রিটের জঙ্গল দেখতে চাননা। তারা চান জঙ্গল ঘেরা গ্রামের ঐতিহ্য যেন জঙ্গলের মধ্যেই ধরা থাকে।

শুধু তাই নয়, স্থানীয় মানুষদের তথা ছেলেমেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক মনস্ক করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্হাটি আরও একটি উদ্যোগ নেয়। গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গ্রামের মেয়ে শ্রীলেখা রায়, রীতা মণ্ডল প্রমুখদের তত্ত্বাবধানে গ্রাম সাজানোর সময় তিন দিন ব্যাপী একটি অনুষ্ঠানও হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আলাদা উৎসাহ দ্যাখা যায়। জানা যাচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও অনুষ্ঠান হবে।

কথা হচ্ছিল সুমন ওরফে কৃষ্ণের সঙ্গে। মানকর কলেজের অধ্যাপক অর্ণব বাবুর ‘আইডিয়া’-র ‘অর্জুন সারথি কৃষ্ণ’ না হলেও গ্রামের ‘সৌন্দর্য সারথি কৃষ্ণ’ তাকে বলা যেতেই পারে। পাশে পেয়ে গিয়েছিলেন মহেশ্বর, প্রণব, সমীরণ, অমিরণ, মান্তু, সোমনাথ, সুমন্ত, রীতা, শ্রীলেখা প্রমুখের মত গ্রামের একঝাঁক উৎসাহি যুবক-যুবতীদের। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় অরণ্যের মধ্যেই বাইরের জগতের কিছুটা আড়ালে নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে লবনধার গ্রাম অনেকেই যাকে আজ আল্পনা গ্রাম বলছেন। বিজ্ঞাপনের ভাষায় – এই সৌন্দর্যের কোনো ভাগ হয়না।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments