ইহুদি, নাৎসি, জার্মানি আর মুসলমান, বিজেপি, ভারতবর্ষ সমার্থক নয়, নিশ্চয়

912

অনন্যা রায়ঃ

তা হলে শেষ পর্যন্ত দেশে নাগরিকত্বের ভিত্তি হতে চলেছে একজন ভারতীয়’র ধর্ম পরিচয়। যে দেশের সংবিধান স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে – রাষ্ট্র হবে ধর্ম পরিচয় মুক্ত, সেখানে পষ্টা পষ্টি ধর্ম পরিচয় টাই হয়ে দাঁড়াতে চলেছে তার জাতীয় তা! পৃথিবীতে এমন ঘটনা অবশ্য নজির বিহীন নয়। উন্নত বিশ্বে যদি ও রাষ্ট্র – ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি রকম কিছু নেই তা সত্বেও স্বচ্ছল দেশগুলি ধর্ম পরিচয় গোপন রেখে বা শাক দিয়ে মাছ ঢেকে ভাল মানুষটি সেজে চরে বেড়াচ্ছে, তেমনটা নয়। ধর্ম নিয়ে গোঁসা থেকেই তো ইজরায়েল রাষ্ট্রটির জন্ম। প্যালেস্তাইনকে খানিকটা খুবলে মুসলমান অধ্যুষিত প্রদেশে ইহুদি দের রোপন করাকে ঘিরেই তো ৭৫ বছর ধরে চলা জাতি – সংঘাতের আসল কারন। আজও মেটেনি।
সেটা ১৯২০ সাল। ইহুদি দের কে সংখ্যা গুরু খ্রীষ্টানদের থেকে পৃথক করার লক্ষ্যে এবং কার্যতঃ সমগ্র ইহুদি ধর্মাবলম্বী দের জার্মানি থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যেই ২৫ দফা কর্মসূচী শুরু করে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি দল। তারা ২৫ দফা কর্মসূচী ঘোষনা করল ১৯২০ তে। ইহুদি – বিরোধী প্রচারে ঝড় তুলে, ইহুদি বিরোধীতাকেই দেশ প্রেম বলে লোকের মনে ‘বিষ’ ঢুকিয়ে ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসে নাৎসি’রা। তারপরই, ক্রমে ক্রমে জার্মানিতে ইহু্দিদের জীবন যাপন, তাদের আচরন বিধি তৈরী করে কম করে ২০০০ টি ফরমান আনল তারা। অচিরেই, সেই সমস্ত আচরন বিধির বেশ কিছু দ্রুত আইনে পরিনত হয়ে গেল, আর তার জেরে জার্মানিতে বেঁচে থাকাটাই দুরদায় হয়ে দাঁড়ালো ইহুদিদের পক্ষে। কেমন ছিল সেই সব ‘কালো কানুন’ দেখে নেওয়া যাক –
* সাল- ১৯৩৪: গোটা দেশে ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ডাক্তারি, আইন, ফার্মাসি পড়ার দরজা বন্ধ।
* সাল- ১৯৩৫: এ সময়ই আনা হল কুখ্যাত ন্যুরেমবাগ আইন গুচ্ছ। তাতে জার্মানিতে ইহুদি দের ভোটাধিকার বাতিলই শুধু নয়, সেখানকার র‍্যেইখশটাগে (সংসদ ভবন) ইহুদি দের প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। ইহুদি দের ওপর ফরমান জারি হল, তারা খ্রীষ্টান সহ জার্মানির ইহুদি ছাড়া অন্য কোনো জাতের মানুষ কে বিয়ে তো দূর – প্রেমের সম্পর্কে ও জড়িত হতে পারবে না।
* সাল- ১৯৩৬: জার্মানির যে কোনও পার্ক, রেষ্টুরেন্ট ও স্যুইমিং পুলে ইহুদি দের প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। পাশাপাশি টাইপ রাইটার, টেপ রেকডার, সাইকেল, দূরবীন ব্যবহার ইহুদি দের জন্য নিষিদ্ধ হল। সমস্ত সরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়, বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ইহুদি ছাত্র ছাত্রীদের, ইহুদি ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের কলেজ, স্কুলে প্রবেশ নিষিদ্ধ হল।
* সাল- ১৯৩৮: শুধুমাত্র ইহুদি দের জন্য আলাদা পরিচয় পত্র চালু হল। সিনেমা, থিয়েটার হল, সমুদ্র তীর ও অনান্য পর্যটন কেন্দ্রে তাদের যাওয়া নিষিদ্ধ হল। প্রতিটি ইহুদি কে তাদের নামের সাথে “সারাহ’ ও ‘ইজরায়েল’ শব্দের একটি যোগ করতে হুকুম করল হিটলার। তাদের পাসপোর্টে লাল “জে” অক্ষরটি বসানো শুরু হল। এ বছরই ৯ ও ১০ নভেম্বর রাত্রে জার্মানি জুড়ে ইহুদি দের ওপর আক্রমন শুরু হল, পোড়ানো হল তাদের ধর্মস্থান – সিনাগগ। লুঠ ও অগ্নি সংযোগ হল তাদের ব্যবসা কেন্দ্র ও দোকান গুলিতে। ওই দুই কালোরাত কে পৃথিবী জুড়ে ইহুদিরা ‘ক্রিষ্টল নাচেট’ বা ভাঙা কাঁচের রাত বলে চিনহিত করে।
* সাল- ১৯৩৯: হাজার হাজার ইহুদি কে ঘর বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হল। তদের রেডিও বাজেয়াপ্ত হল। হিটলার ইহুদি দের হুকুম করল- তাদের সোনা, রুপো, হীরে, জহরত সব রাষ্ট্রের সম্পত্তি। সে সব সরকারের কাছে জমা করতে হবে। ইহুদি দের বিরুদ্ধে জারি করা করা হল কার্ফু।
* সাল- ১৯৪০: জার্মানিতে বসবাসকারী সমস্ত ইহুদির ওপর টেলিফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হল।
* সাল- ১৯৪১: ইহুদি দের দেশ ছাড়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হল।
* সাল- ১৯৪২: ইহুদি দের ডিম, দুধ কেনার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি। এমনকি পশমের কোট, উলের পোষাক বাজেয়াপ্ত হল। এ সবই জার্মানি, নাৎসি এর ইহুদি দের কথা। এ দেশের প্রতিটি নাগরিক এখনো বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন এর সাথে ভারতবর্ষ, বিজেপি ও মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here