মনোজ সিংহ, মলানদিঘিঃ- আপাদমস্তক ধবধবে একটি ছায়া হেঁটে আসছে আলো-আঁধারির আড়াল চিরে, পাঁচতলার করিডোরে। গা-ছমছমে ওই করিডোরে এখন জীবন-মৃত্যুর হীম শীতল নৈঃশব্দ। যে নিস্তব্ধতার আলতো প্রশ্রয়ে সটান হেঁটে আসে সাদা-লিবাসের ওই ছায়া। ভূত নয়, কাছে, খুব কাছে এসে নরম গলায় কথা বলে ‘ভগবান’! যত্নের স্পর্শ রোগীর কপালে, অক্সিমিটার রোগীর তর্জনীতে ক্লিপ করতে করতে বললেন, “ঠিকই আছে তো দেখছি। ভয় পাবেন না। আপনি সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরবেন। ক’টা দিন আমাদের এখানে একটু আরাম করুন।” এক ঝটকায় ‘মরার ভয়ে’ কুঁকড়ে যাওয়া রোগী উঠে বসলেন কোভিড হাসপাতালের বিছানায়। চোখ তার অন্য বেডে, যেখানে শুয়ে ভয়ে ‘কাঠ’ হয়ে যাওয়া তার বছর ছত্রিশের স্ত্রী। ভগবানের সাদা ছায়া তখন সেখানে। সাথে আসা নার্সিং সিস্টার কে নির্দেশ দিলেন, “এনার দেখছি ব্লাড-সুগার রয়েছে। হাতে একটা চ্যানেল করে রাখুন, যদি দরকার লাগে।” বেড’র মাথার দেওয়ালে অক্সিজেন পয়েন্ট যেই পরীক্ষা করতে গেলেন, ভিজে গেল পাঁচতলার ওয়ার্ডের ওই ফ্লোরের খানিকটা। ‘ভগবানে’র শরীর নিঙড়ে পি.পি.ই. কীটে জমে থাকা ঘাম- ঝর ঝর করে ঝরে পড়ল ফ্লোরে। এবার খানিক লজ্জিত ভগবান! এটা রোজকার ব্যাপার।
— একেই বলে ঘাম ঝরানো রোজগার?
— “রোজগার? টাকার জন্য দিনে ৯ ঘণ্টা এই পি.পি.ই. কীট পরে শরীর ভেঙে ডিউটি করছি? এটা কোভিড হাসপাতাল। দুরদুরান্ত থেকে রেফার হয়ে আসা, ভয়ার্ত, অসহায়, ভেঙে পড়া মানুষের জন্য না হয় শরীর একটু ভাঙলো। তাতে কি,” বলে থামলেন ডাঃ সুদীপ কুণ্ডু। দুর্গাপুরের একমাত্র কোভিদ-১৯ হাসপাতাল সনকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মলানদিঘির এই হাসপাতালের কোভিড ইনচার্জ। বললেন, “তামামা দুনিয়া এই রোগের নাম শুনলেই ভয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। ও রকমটা করলে কি আমাদের চলে? যারা এখানে নতুন জীবন পেতে ছুটে আসছে, তাদেরকে সুস্থ করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে যে দিতেই হবে। এটাই এখানে আমাদের সবার জেদ বা একমাত্র চ্যালেঞ্জ বলতে পারেন।”
দোতলার দক্ষিন-পশ্চিম দেওয়াল ঘেঁষে একটি বেড-এ প্রবল শ্বাসকষ্টে ছটফট করছেন বৃদ্ধ। এয়ার কন্ডিশনড ঘরেও বৃদ্ধের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাক-মুখ ঢাকা ভেন্টিলেটারের খাঁজ কাটা নলের অ্যাডাপ্টারে, যেখান দিয়ে বেয়ে আসছে কাটোয়ার কেতুগ্রাম থেকে আসা বৃদ্ধের জন্য প্রানদায়ী বায়ু। ডাঃ কুণ্ডু’র চোখ মনিটরে স্থির। সর্বোচ্চ মাত্রায় ভেন্টিলেটার চলছে, বৃদ্ধের শরীরে অক্সিজেন মাত্রা কিছুতেই ৬০ শতাংশ থাকছে না। ইনি লেভেল- ৪’র কোভিড রোগী। চারদিন কেটে গেল, অবস্থা খারাপ হচ্ছে দিন দিন। ডাঃ কুন্ডুর কপালেও জমছে ঘাম। বিন্দু-বিন্দু। ভাবছেন, “এই মানুষটিও হয়তো থালা বাজিয়েছিল, দীয়া জ্বালিয়েছিল আমাদের জন্য। অথচ…” বিড়বিড় করছেন ডাঃ কুন্ডু। মনে পড়ে যায় ওই থালা বাজানো হাতগুলিই কেমন আলাদা করে দিয়েছে তাকে, তার পরিবারকে। কাছেই বামুনাড়া’র তপোবন হাউসিং এ তার ঘর। সেখানেও তো সেদিন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থালা বাজানোর ধুম ছিল। আরেকদিন সন্ধ্যায় অকাল দীপাবলীতে জানালা, বারান্দায় দীয়া, মোমবাতি মনে জাগিয়ে ছিল সাহস, ভরসা। কিন্তু অচিরেই ডাঃ কুন্ডু’র চেতনা ফিরলো যখন একে একে বন্ধ হয়ে গেল তার ঘরে দুধ, শাক সবজি সরবরাহ। আটকে দেওয়া হল তার বাড়ীতে কাজে আসা গৃহপরিচারিকা কে। “ওই থালা বাজানো লোকেরাই কাজের মাসীকে বলে দিল- ও বাড়ীতে কাজ করলে আমাদের ঘরে এসো না। আটকে দিল দুধওয়ালাকে। সব্জিওয়ালারও আমার কাছে আসা বারন। কারন- আমি কোভিড রোগীদের ডাক্তার।” চোখের জল ধরে রেখে ডাঃ কুন্ডু বললেন, “আমার দু’বছরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা সয়ে ঘর সামলাচ্ছে আমার স্ত্রী। আমি ১০ টায় ঢুকি হাসপাতালে, ফিরি রাত্রী সাড়ে ১১ টায়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা রোগীদের দেখি আর মনে মনে ভাবি- এনারাও হয়তো ঘরে ফিরে গিয়ে কোনোদিন আমাদের কে অচ্ছুৎ বলবেন! এরপরই উজ্জ্বল একগাল হাসি তার- “হোতা হ্যায়, হোতা হ্যায়, চলতা হ্যায়!” ধীরে ধীরে আবার ওয়ার্ডের করিডোরে হারিয়ে গেল সেই সাদা দীর্ঘ একটা ছায়া!