লখনউ চলুন ভ্রমণ করে আসি কৌস্তুভ করের সাথে

1129

This city smells of
Nawab, Kebab & Aadab
– Zainab Mariya ভূপর্যটক জৈনব মারিয়ার এই কথা গুলি লিখেই আমার লখনউ ভ্রমণ কাহিনীর সূচনা করলাম ।অনেক দিন ধরেই লখনউ যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু বিভিন্ন কারণের জন্য আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি । গত বছর হাতে চার দিন সময় নিয়ে দমদম থেকে লখনউ এর বিমান ধরলাম । অনেকেই লখনউ দেখার জন্য একটা দিনই হাতে সময় রাখে। কিন্তু আমি তিনটে দিন হাতে সময় রেখেছিলাম। কারণ একটু ভালোভাবে ঘুরবো বলে। যেকোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে সময় একটু বেশি দিতে হবে। তা না হলে ফিরে এসে লোকের কাছে দেখেছি বলেই গল্প করা যায়, নিজের মন ভরে না। যেকোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনকে একটু সময় নিয়ে না দেখ্লে তার গুরুত্বটাও ঠিক মতো বুঝে ওঠা যায় না । যাক ও সব কথা, এবার লখনউ এর অতীত ও বর্তমান নিয়ে দু চার কথা বলি । অতীতের লক্ষণাবতী আজ নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে লখনউ । যেকোনো প্রাচীন শহরই কোনো না কোনো নদীর ধারে অবস্থিত হয় । লখনউ এর ব্যতিক্রম নয় । গোমতী নদীর ধারেই অবস্থিত উওর প্রদেশের বর্তমান রাজধানী এই লখনউ এর । উওর প্রদেশের আয়তন ২,৪৩,২৯০ বর্গ কিলোমিটার , জনসংখ্যা ১৯,৯৮,১২,৩৪১ জন এবং প্রধান ভাষা হিন্দী। লখনউ শহর কে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। পুরাতন লখনউ এবং নতুন লখনউ। সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলিই আছে এই পুরাতন লখনউয়ে। গঙ্গার শাখা নদী গোমতী এই লখনউ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে। এপারের সাথে ওপারের একাধিক সেতু দিয়ে যোগাযোগ গড়া হয়েছে । গোমতীর সাথে সরযূ নদীরও মিলন ঘটেছে । ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ কবি William Howard Russell লখনউ শহর কে দেখে বলেছেন আমার দেখা শহর গুলির মধ্যে সবথেকে সৌন্দর্য পূর্ণ শহর। এই শহরের সৌন্দর্য আমাকে বিমোহিত করে । পুরাণ অনুযায়ী সূর্যবংশীয় রাজাদের হাতে এই লখনউ শহরের পওন হয়। ১৬ শতকে মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই এই শহরের উন্নতির শুরু । হিন্দু ও মুসলিম উভয় সংস্কৃতিই মিলেমিশে সাজিয়ে তুলেছে আজকের এই আধুনিক শহর লখনউকে । এই ভাবে যদি লখনউয়ের বিবরণ লিখতে আরম্ভ করি তাহলে এখনও বেশ কয়েক পাতা লিখে যেতে হবে । যাইহোক লখনউয়ের বিবরণ আর না বাড়িয়ে , লখনউয়ের দেখার জায়গা গুলির বিবরণে আসি । বিকেল বেলায় লখনউ বিমানবন্দরে নেমে হোটেলে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । হোটেলে এসে ঐ দিন আর কোথাও বের হলাম না । ঐ দিন হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকালে লখনউ দেখতে বের হলাম । প্রথমেই আমরা দেখতে গেলাম বড়া ইমামবাড়া । এটি শিয়াধর্মী নবাবদের শোক পালনের জায়গা । এটি তৈরি করান নবাব আসাফ-উদ্-দৌলা এবং এটি তৈরি করতে সময় লাগে ১৫ বছর । চার তলা এই প্রাসাদ পুরীর উপরে আছে এক আশ্চর্য ভুলভুলাইয়া । এর অর্থ ভুলে যাওয়া । এর ভিতরটা এক গোলকধাঁধা । পিলার ছাড়া এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম খিলানাকৃতি হল্ । এখানে ৪৮৯ টি দরজা আছে যেগুলো একই মাপের এবং একই রকমের । এখানে গাইড ছাড়া যাওয়া উচিত নয় । গাইড ছাড়া গেলে পথ হারাবার ভয় থাকে । এই ভুলভুলাইয়ার উপর থেকে লখনউ শহরকে খুবই সুন্দর দেখতে লাগে । এরই বিপরীতে আছে শাহী বাওলি এবং ভুলভুলাইয়ারই পাশে আসাফ উদ্ দৌলা মসজিদ । একটু দূরেই ইমামবাড়ার প্রবেশ তোরণ রুমি দরজা । এই বিশালাকার দরজাটির উচ্চতা ষাট ফুট । এটিও আসাফ উদ্ দৌলার তৈরি । এরপর আমরা দেখতে গেলাম ভিক্টোরিয়া পার্ক । এখানে ব্রিটিশদের সমাধি আছে । রড় ইমামবাড়া, বাওলি, ভুলভুলাইয়া ও পিকচার গ্যালারি ৫০ টাকার টিকিট কেটেই দেখে নেওয়া যায় । বড় ইমামবাড়া দেখে পর আমরা গেলাম ছোট ইমামবাড়া দেখতে । এই দুই ইমামবাড়ার মাঝেই পথের ধারে পড়ে ক্লক টাওয়ার । এরপর আমরা দেখতে গেলাম জুমা মসজিদ । তারপর আমরা গেলাম গোমতীর পশ্চিম তীরে শহীদ মিনার দেখতে । এখানে গোমতী নদীর বুকে বোটিং করার ব্যবস্থা আছে । এইসব গুলি দেখে বিকেলে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে । একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরলাম কিছু কেনাকাটা করতে । চিকনের শাড়ি বা অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে আপনারা যেতে পারেন লখনউ রেল স্টেশন থেকে ১ কিলোমিটার দূরে আমিনাবাদে অথবা বড় ইমামবাড়ার কাছে চকবাজারে । শুক্রবার চকবাজার এবং বৃহস্পতিবার আমিনাবাদ বন্ধ থাকে । পরদিন সকালে প্রথমেই আমরা গেলাম হজরতগঞ্জে শাহনাজাফ ইমামবাড়া দেখতে । তারপর গেলাম বানারসীবাগে চিড়িয়াখানা ও বটানিক্যাল গার্ডেন দেখতে । এরপর আমরা দেখতে গেলাম La Martiniere College দেখতে । এটি একটি Private school এবং এটি স্থাপন করেন মেজর জেনারেল Claude Martin, ১৮৪৫ সালে । জায়গাটা সাজানো গোছানো এবং খুবই সুন্দর । এরপর আমরা দেখতে গেলাম Janeshwsr Mishra Park. এটিও সাজানো গোছানো সুন্দর একটি পার্ক । ছোট থেকে বড় সবাইকার জন্যই এখানে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে । দুপুরের খাবার খেয়ে এবং একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকালে চলে এলাম Dr. Ambedkar পার্ক । বিশাল এলাকা জুড়ে এই পার্কটি । তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এই পার্কটি তৈরি করে ছিলেন । বর্তমানে যারা লখনউ বেড়াতে যান তারা এই পার্কটি অবশ্যই দেখেন । এরপর গোমতী রিভার ফ্রন্ট পার্ক এবং চনদ্রিকাদেবী মন্দির দেখে রাত্রি প্রায় নয়টার সময় হোটেলে ফিরে এলাম । লখনউ যেহেতু ঐতিহাসিক শহর তাই এখানে অনেক দেখার জিনিস আছে । মনেহলো আরো একটা দিন বাড়তি সময় পেলে ভালো হতো । পরদিন বিকেলে আমাকে কলকাতার বিমান ধরতে হবে । লখনউ শহরের দ্রষ্টব্য জায়গা গুলি দেখানোর জন্য বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থা আছে । UPSTDC দপ্তর বসেছে গোমতী নগরের হোটেল গোমতীতে । চারবাগ রেল স্টেশনের কাছ থেকে এদের বাস ছাড়ে । এখানেও এদের Booking Office আছে । যারা খাদ্য রসিক তারা লখনউয়ের বিরিয়ানি অবশ্যই একবার খেয়ে দেখবেন । মোঘল আমলের বিভিন্ন রকমারি খাবারের জন্য হজরতগঞ্জের কোয়ালিটি, রঞ্জনা ও রয়েল কাফে আর চীনা ডিসের জন্য হজরতগঞ্জেরই মহাত্মা গান্ধী রোডে জন হিং বা হংকং রেস্টুরেন্টে যেতে পারেন । গোমতী নগরের L- 14 All Day Dinning, Sepia ও Rocca – র যথেষ্ট খ্যাতি দেশী ও বিদেশী খাবার পরিবেশনের । সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান ও জলখাবার খেয়ে স্থানীয় বাজার থেকে শুধুমাত্র লখনউতে পাওয়া যায় এরকম কিছু জিনিসপত্র কিনে হোটেলে ফিরে এলাম এবং দুপুর একটা নাগাদ লখনউ কে বিদায় জানিয়ে চৌধুরী চরণ সিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here