eaibanglai
Homeএই বাংলায়গণপুরে আজও নবমীর দিন মাতৃপুজোর সঙ্গে গ্রহরাজের পুজো হয়

গণপুরে আজও নবমীর দিন মাতৃপুজোর সঙ্গে গ্রহরাজের পুজো হয়

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী,মঙ্গলকোটেঃ- ব্যক্তিগত পুজো যে সার্বিক হতে পারে দীর্ঘদিন ধরেই তার নিদর্শন পাওয়া যায় পশ্চিম মঙ্গলকোটের গণপুরের ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গা পুজোয়। যেভাবে সমস্ত গ্রামবাসী এখানকার পুজোয় অংশগ্রহণ করে তাতে দেখলে মনে হবে এটা বারোয়ারি পুজো। আসলে আন্তরিকতার মাধ্যমে ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যরা আপন করে ফেলেছে সমগ্র গ্রামবাসীদের। গত প্রায় সাতশ বছর ধরে সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলে আসছে।

সাধক রামচন্দ্র ন্যায়বাগীশের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজো। মাটির ঘরে ‘মা’ এলেও সেখানে বরাবরের মত ভক্তির কোনো অভাব ছিলনা, আজও নাই। আজও সপরিবারে ‘মা’ আসেন এক পাটাতে। ইউনেস্কো বাঙালির দুর্গাপুজোকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ভাবা হয়েছিল এবার হয়তো এখানে মূর্তির বিবর্তন ঘটবে। নতুন প্রজন্মের সদস্যরা হয়তো মূর্তির মধ্যে আধুনিকতা খুঁজবে। তারা চাইবে তাদের মায়ের মুখের মধ্যে কোনো জনপ্রিয় শিল্পীর মুখের ছোঁয়া থাকুক। কিন্তু কি আশ্চর্য, নব প্রজন্ম সেটা চায়নি। তাইতো আশেপাশের শত পরিবর্তনের মধ্যেও মূর্তির মধ্যে আছে সাবেকিয়ানার ছাপ, যাকে দেখলেই ভক্তির ভাব আসে মনে। তবে একটা পরিবর্তন হয়েছে। ‘মা’ এখন মাটির ঘরের পরিবর্তে আসছেন নব নির্মিত দালান ঘরে। কারণ ১৯৭৭ সালের ভয়ংকর বন্যায় মাটির ঘর ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো মায়ের বেদির কোনো ক্ষতি হয়নি। পরিবারের সদস্যরা মনে করেন – মায়ের মাহাত্ম্য। ফলে ভক্তির অভাব নাই।

সূর্য ওঠার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এখানে ঘট আনা হয়। ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যদের দাবি আগে নাকি ঘট আনার সময় শঙ্খচিল দেখা যেত। যদিও এখন সেসব দেখা যায় না। একটা সময় সপ্তমী পুজোর দিন মায়ের ভোগ খাওয়ার জন্য বহু মানুষের ভিড় হতো। এমনকি কয়েকজন ‘ফকির’-কেও পুজোর ভোগ খেতে দেখা যেত। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন ফুটে উঠত। কিন্তু করোনা জনিত কারণে সেসব আজ প্রায় বন্ধ। এখানে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। তাই অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে চালকুমড়ো বলি হয়। তখন কার্যত গোটা গ্রাম ভিড় জমায় পুজো প্রাঙ্গনে। সত্যিই এক দেখার মত দৃশ্য। এখানে বলির পর ঢোল বাদকদের ইঙ্গিত পাওয়ার পর আশেপাশের গ্রামে বলি হয় । নবমী পুজোর দিন মাতৃপুজোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রহরাজেরও পুজো হয়। শোনা যায় স্বয়ং গ্রহরাজ নাকি সাধক রামচন্দ্র ন্যায়বাগীশকে এই নির্দেশ দিয়ে যান। আজও এই বংশের বংশধররা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। দশমীর দিনের অন্যতম আকর্ষণ সিঁদুর খেলা। ঘট বিসর্জনের আগে বিবাহিতা থেকে অবিবাহিতা প্রত্যেকেই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। দোল উৎসবকেও ছাড়িয়ে যায় সিঁদুর খেলার দৃশ্য।

ব্যক্তিগত পুজো হলেও অনেক জায়গায় বাইরের পুরোহিত পুজো করে। কিন্তু এখানে ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরাই পুজো করে। নবমীর দিন তালপাতায় লেখা মন্ত্র আজও পাঠ করা হয়। এখানে প্রতিদিন নানা ব্যঞ্জন সহকারে দু’বার করে ভোগ হয় – দিনে ভাত ভোগ এবং রাতে লুচি ভোগ। তবে নবমীর ভোগ কেবলমাত্র পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তৈরি করে, মহিলাদের কোনো অনুমতি নাই।

আগে পুজোর সময় চারদিন ধরে যাত্রা সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সাঁওতালি নৃত্য ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা বন্ধ থাকলেও অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো আজও হয়। বহিরাগত পেশাদার শিল্পী নয়, গ্রামের শিল্পীরাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।

কর্মসূত্রে ভট্টাচার্য পরিবারের অনেক সদস্য এই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। কেউ কেউ অন্য রাজ্যেও আছে। কিন্তু পুজোর সময় প্রত্যেকেই গ্রামে ফিরে আসে। এমনকি পরিবারের বিবাহিতা মেয়েরাও বাপের বাড়ি আসে। অন্য সময় ভট্টাচার্য পাড়া ফাঁকা থাকলেও পুজোর সময় জমজমাট হয়ে ওঠে।

পরিবারের অন্যতম প্রবীণ সদস্য অসিত ভট্টাচার্য বললেন – একটানা সাতশ বছর ধরে আমরা পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও দেখছি একই পথ অনুসরণ করছে। এইভাবেই হয়তো যুগ যুগ ধরে ভট্টাচার্য বাড়ির ঐতিহ্য বজায় থাকবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments