একদিকে পণের বলি দুই গৃহবধূ, অন্যদিকে মেয়ের বিয়েতে দরিদ্রদের মুখে অন্ন তুলে দিলেন বাবা – উঠে এল একই সমাজের দুই ভিন্ন ছবি

1302

নিউজ ডেস্ক, এই বাংলায়ঃ সমাজ এগিয়েছে। আমরাও এগিয়েছি। কিন্তু বদলায়নি মানসিকতা। আজও আমাদের সমাজে পণপ্রথার বলি হন মহিলারা, গৃহবধূরা। কখনও আত্মহত্যা, আবার কখনও শ্বশুরবাড়ির লোকের হাতে খুন হতে হয় আমাদের সমাজে নারীদের। প্রত্যেক দিন খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় এইধরনের ঘটনা আজ প্রতিনিয়ত দেখতে পাওয়া যায়। আবারও সেই একই নৃশংস ঘটনার সাক্ষী থাকল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ থানা এলাকা। দুই ভিন্ন গ্রামে দুই গৃহবধূকে পণের দায়ে প্রাণ হারাতে হল আজকের এই সমাজেও। জানা গেছে ২০ বছরের গৃহবধূ নির্মলা শিকারির বিয়ে হয়েছিল কমল মন্ডলের সঙ্গে। পেশায় নাপিত কমল মণ্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সে নির্মলা দেবীকে বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিত। মঙ্গলবারও একই কারণে ফের দুইজনের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। অভিযুক্ত কমল মণ্ডল স্ত্রীকে বাপের বাড়ি থেকে ৮ হাজার টাকা আনার জন্য চাপ দিলে অশান্তি সহ্য করতে না পেরে ফাঁকা মাঠে গিয়ে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আত্মহত্যা করে ওই গৃহবধূ। অন্যদিকে একই থানা এলাকার রামানন্দপুর গ্রামে বছর পচিশের ফরিদা বিবির ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল শ্বশুরবাড়ি থেকে। জানা গেছে, মাত্র দেড় মাস আগে পেশায় ট্রেলারিং মিস্ত্রি রেজাউল মোল্লার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ফরিদা বিবির। হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে ফরিদার বাপের বাড়ির তরফে বিয়েতে টাকা-পয়সা, গয়না কিছুই দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। ফলে, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় অত্যাচার। একাধিক বার টাকা ও সোনা গয়না আনার জন্য চাপ দিতে থাকলে বুধবার মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় ওই নববধূ। ঘটনার পর থেকেই পলাতক স্বামী রেজাউল মোল্লা। তার খোঁজে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। একদিকে পনের দায়ে একের পর এক পরিবার তথা নারী সমাজ যখন বিপন্ন তখন আমাদের এই সমাজের এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন মানবিকতা আজও টীকে আছে এই সমাজে। নিজের মেয়ের বিয়েতে গোটা এলাকার হতদরিদ্র, অসহায় মানুষকে পাত পেরে খাওয়ালেন মেয়ের বাবা। বিষ্ণুপুরের গোপালপুরের বাসিন্দা সহদেব নন্দী। মেয়ে ঝুম্পা নন্দীর বিয়ে ঠিক করেছিলেন। পাড়া, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা ছিল অনেক বড়। মেয়ে চেয়েছিল নিজের বিয়েতে অসহায় মানুষগুলো যেন একবেলা পেট ভরে খেতে পায়। মেয়ের আবদারে সাময়িক বিভ্রান্ত কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করে এত জোগাড়জান্তি করবেন একা হাতে। ঠিক তখনই সহদেব বাবুর সদ্য বিবাহিত মেয়ে বাবাকে জানিয়েছিল, বিষ্ণুপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন যুবককে জানালেই তারা সমস্ত ব্যবস্থা করে নেবে। সেইমতো খবর যায় প্রয়াসের কাছে। ডাক পাওয়া মাত্র নিজেরা একা হাতে এলাকার সমস্ত গরীব মানুষদের পেট ভরে খাওয়ালেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সহদেব নন্দী। সত্যি, কি বিচিত্র এই সমাজ। একদিকে, দরিদ্র পিতা নিজের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত জীবনের করুন পরিণতির স্বীকার হচ্ছেন, আর অন্যদিকে অপর এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মেয়ের আবদার মেটাতে গরীব মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন। অথচ আমাদেরই এই সমাজ অর্থের লোভে এই বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শুধুমাত্র কিছু টাকার লোভে চিরজীবনের মতো কেড়ে নিচ্ছেন তাদের প্রাণের সন্তানদের। পনের দায়ে প্রত্যেক দিন ঝরে যাচ্ছে কত শত প্রাণ। এই তো আমাদের সমাজ। আধুনিকতার চরম শিখরে পৌছেও আজ প্রাচীন পণ প্রথার মতো নৃশংস প্রথা থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারে নি, অথচ তারাই যখন রাস্তায় বেরোন, তখন নিজেদের গায়ে চড়িয়ে বেরোন আধুনিকতার মিথ্যে পোষাক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here