বড়দিনের সকালে ছন্দপতন। সোমবার গভীর রাতে দুর্গাপুরের অডিও-ভিজুয়াল কেবল নিউজ চ্যানেলের স্রষ্টা ও সবার প্রিয় বর্ষীয়ান সাংবাদিক প্রদীপ চ্যাটার্জী (আমাদের প্রদীপ দা) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও সাংবাদিকদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন প্রদীপ দা। আজকের দিনে দুর্গাপুরে যেসমস্ত সাংবাদিক বিভিন্ন নামীদামী পত্রপত্রিকা ও নিউজ চ্যানেলে কর্মরত তাদের অনেকেই নিজের সাংবাদিকতার জীবন শুরু করেছিলেন এই প্রদীপ দা-র হাত ধরেই। সদা সর্বদা হাসি-খুশি থাকা অন্যের দুর্দিনে ও দুঃসময়ে পাশে থাকার এক নজির ছিলেন এই প্রদীপ দা। প্রায় ৩০ বছর আগে গোপালমাঠ নিবাসী প্রদীপ দা সাংবাদিকতার পেশায় যোগদান করেন এবং একটি পাক্ষিক পত্রিকার (সাম্প্রতিক) সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। যারা দুর্গাপুরের আদি বাসিন্দা তারা অনেকেই জানেন যে প্রদীপ দা-র যেকোনো মানুষের সঙ্গে মিশতেই কয়েক মুহুর্ত মাত্র সময় লাগত। তাঁর সাংবাদিকতার দীর্ঘ জীবনকালে শুধু যে চড়াই ছিল তা নয়, বহুবার উতরাইও দেখেছেন তিনি। কিন্তু কোনও কিছুতেই দমিয়ে রাখা যায় নি প্রিয় প্রদীপ দা-কে। তিনি আবার স্বমহিমায় ও স্বগর্বে শীর্ষস্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। সিটিসেন্টারের কোর্ট সংলগ্ন একটি ছোট্ট স্টলে ছিল তাঁর অফিস। সকাল থেকে রাত অবধি ছিল আট থেকে আশির অবাধ আনাগোনা। সবার সঙ্গে হাসি মুখে সবার সমস্যার সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন প্রিয় প্রদীপ দা। প্রায় ১০-১২ বছর আগে সিটিসেন্টার থেকে তাঁর গোপালমাঠের বাড়িতে ফেরার সময় ফরিদপুরের কাছে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন প্রদীপ দা। সেইদিনও যখন তাঁকে সিটিসেন্টারের একটি হাসপাতালে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সারা শরীরে হাজার ক্ষতর জ্বালা যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও তিনি হাসি মুখে ঘটনার বিবরণ দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘এইরকম ছোট খাটো দুর্ঘটনায় আমি মরণেওয়ালা নই রে’। সেই দুর্ঘটনায় তাঁর হাতের অনেকটা অংশে গভীর ক্ষত হয়েছিল, সেই ক্ষত সারাতে তিনি ছুটে যান সুদূর ব্যাঙ্গালোরে এবং স্কিন গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে আবার সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন আমাদের মাঝে। আজ প্রদীপ দা-র অনেকগুলি কথার মধ্যে একটা কথা আমার খুব মনে পড়ছে। আমি তখন সাংবাদিকতার পেশায় নতুন এসেছি ও খুব সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তাম খবরের সন্ধানে। একদিন প্রদীপ দা সকালবেলায় আমাকে রাস্তায় দেখে বলল, ‘এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস’? আমি বললাম খবর খুঁজতে। বলল দূর গাধা, সকালবেলায় ক্ষেতমজুর আর দিনমজুররা কাজে বেরোয়, সাংবাদিকদের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে ১১টার সময় বেরনো উচিত, কারণ তারপরে কখন খাবার জুটবে তার তো কোনও ঠিক নেয়। সাংবাদিকদের কোনও লাঞ্চ টাইম হয় না। এই কিছুদিন আগে হঠাত একদিন গোপালমাঠে চৌরাস্তায় দেখা হল প্রদীপ দা-র সাথে। বললেন, তোকে একটা খবর দেওয়া হয়নি রে। মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। সামনের ২০১৯-র জানুয়ারিতেই বিয়ে। তুই কিন্তু ভাই দুদিন কোনও কাজ রাখিস না, কারণ আমি তো একা, তুই কাছে থেকে সব কাজটা নিজের মতো করে পার করে দিস। আজ খুব সকালবেলায় যখন তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম, তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ওইরকম একটা প্রাণোজ্বল, শক্ত-সামর্থ মানুষ কিভাবে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। বলার কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু যতদিন বাঁচবো, প্রদীপ দা তোমার কথা মনে থাকবে, আর তুমি যে যে কথাগুলো বলেছিলে সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। প্রদীপ দা-র মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। এক কন্যা ও স্ত্রীকে রেখে তিনি ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে গমন করলেন। খুব মিস করছি প্রদীপ দা, যেখানেই থাকো ভালো থাকো। তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি। প্রণাম নিও।